top of page
IMG_20180621_143754.jpg

পলাশন এম এম উচ্চ বিদ্যালয় ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়েছে। একাধিকবার স্থান পরিবর্তনের পর অবশেষে এই বিদ্যালয় পলাশন বাজারের প্রাণকেন্দ্রে স্বমহিমায় বিরাজমান। বর্তমানের মত অতীত একটা সত্ত্বা। কিন্তু তাই বলে অতীত মোটেই মৃত বা মূক নয়, নয় বিস্মৃতিও। অতীত সরব হয়ে বর্তমানের প্রাণস্পন্দনে মিশে তার গতিকে বাড়িয়ে দেয়। সমৃদ্ধ অতীত বর্তমানের বৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করে। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এই বিদ্যালয় একশত ছত্রিশ বছরে পা রেখেছে। এতগুলো বছর অতিক্রম করে বিভিন্ন উত্থান-পতন, ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে আজকের এই অবস্থায় উন্নীত হওয়া একটা বিদ্যালয়ের পক্ষে কিছু কম কথা নয়। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে এই বিদ্যালয়ের যে বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল তা আজ ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ হয়ে একটি মহীরুহে পরিণত হয়েছে। শতাব্দীপ্রাচীন এই বিদ্যালয়টি যা কিনা শুধুমাত্র পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণি নিয়ে শুরু হয়েছিল আজ সেটি বিজ্ঞান ও কলা বিভাগসহ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। সুদীর্ঘ একশত ছত্রিশ বছরের এই বিদ্যালয়ের একটা গৌরবময় অতীত রয়েছে। আর সেই গৌরবের স্রষ্টা, ধারক ও বাহক এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক মহাশয়েরা।

 

  পলাশন গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় শুরু হওয়ার আগে দুটি খুব নামকরা পাঠশালা ছিল। একটি তাঁতি মাস্টারের এবং অপরটি ভগিরথ মাস্টারের। গ্রামের কলু পুকুরের পূর্ব পাড়ে তাঁতিপাড়া ছিল, সেখানেই তাঁতি মাস্টার পড়াতেন। আর ভগিরথ মাস্টার পড়াতেন গ্রামের উত্তর পাড়ায়। বাদশাহী রাস্তার পশ্চিম দিকের বেশ কিছু অংশকে গ্রামের লোকের উত্তরপাড়া বলে। কেন যে বলে কেউ এর  ঠিক সদুত্তর দিতে পারেনা। তাই তাঁতি মাস্টার এবং ভগিরথ মাস্টার কোথা থেকে লেখাপড়া শিখেছিলেন তা কিন্তু অজানা। এই গ্রামে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৩২০বঙ্গাব্দের বেশকিছু পূর্বে। সেই সময়ের উদ্যোক্তা যারা ছিলেন তাদের সঠিক তথ্য আজও অজানা, তবে এ নিয়ে একটা বিতর্ক আছে। অনেক প্রাচীন মানুষ এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা হিসেবে ভগিরথ মাষ্টারের নাম করে থাকেন, আবার অনেকক্ষেত্রে শোনা যায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগ এসেছিল তাঁতি মাস্টারের তরফ থেকেই পরে ভগিরথ মাস্টার নাকি তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করে। যাইহোক, প্রথম প্রথম এই বিদ্যালয়টি সম্পূর্ণ বিদ্যালয়ের মত ছিল না, অনেকটা  পাঠশালা ধরনের বিদ্যালয়ের মতো করে শুরু হয় গ্রামের দক্ষিণ দিকে দেবখাল সংলগ্ন ঘোলা পুকুরের পশ্চিম পাড় ঘেঁষে, যা এখনো প্রাচীন লোকেদের কাছে 'স্কুলডাঙ্গা' নামে পরিচিত। ১৩২০ বঙ্গাব্দে এই এলাকায় এক ভয়ংকর বন্যা হয়, যা 'বিশ সালের বান' নামে পরিচিত। আর এই প্রবল বন্যার সময় স্কুলবাড়ি সম্পূর্ণ ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। পরবর্তীতে দুর্যোগ কেটে যাবার পর আবার স্কুল বাড়ি নির্মাণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু গ্রাম্য দলাদলি হবার কারণে স্থান নির্বাচনে  সকলে একমত হতে পারে না। গ্রামের প্রভাবশালী সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গের প্রাধান্যে বিদ্যালয় স্থানান্তরিত হয় এবং তা চলে আসে বর্তমানের বারোয়ারি তলায়। কিছু তৎকালীন বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি যেমন পশুপতি ঘোষ (যিনি চকদিঘির জমিদারের দেওয়ান ছিলেন), হরিপদ তা ও অন্যান্য অনেকেই বিদ্যালয় নির্মাণে সহায়তা করেন। চকদিঘীর জমিদার লীলা মোহন সিংহ রায় এর অর্থানুকুল্যে পাঠশালা ধরনের এই বিদ্যালয়কে টিকিয়ে রাখা হয়। এই পাঠশালা ধরনের বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা দিবস ধরা হয় ইংরেজির ১৭ ই ফেব্রুয়ারি। সবই প্রাচীন ব্যক্তিদের কাছে শোনা, তাই এই বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এরপর পুনরায় এই বিদ্যালয়ের স্থান পরিবর্তন হয়ে চলে আসে বাদশাহী রাস্তার পশ্চিম ধারে যেখানে ছুতররা বসবাস করত। সেখানেই অফিস, স্টাফ রুম ও অন্যান্য স্কুল বাড়িটি ছিল, (যদিও ইং-২০১৮ সালে অফিস ও স্টাফ রুম স্থানান্তরিত হয়ে যায়)। পরবর্তীতে ছুতরদের কাছ থেকে জায়গা কিনে ঘরবাড়ি করে নতুন স্কুল বাড়িতে পঠন-পাঠন শুরু হয়, আর তার সাথে সাথে চলতে থাকে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ইংলিশ স্কুলে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা। বেশ কয়েক বছর এইভাবে চলার পর অনেক প্রচেষ্টার ফলে  ১৯৩৬ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাথে সাথে মিডিল ইংলিশ স্কুল চালাবার অনুমতি মেলে। মিডিল ইংলিশ স্কুল চলার সাথে সাথে আবার নতুন উদ্যোগ শুরু হয়ে যায় কিভাবে একে টু ক্লাস ইংলিশ স্কুল থেকে ফোর ক্লাস ইংলিশ স্কুলে রুপান্তরিত করা যায়। কিছু জায়গার সন্ধান করা হয় বাদশাহী রাস্তার পূর্বধারে (ছুতারদের জায়গার ঠিক উল্টো দিকেই) রাস্তা সংলগ্ন কিছু অংশ গ্রামের তৎকালীন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব সিদ্ধেশ্বর ঘোষ মহাশয় বিদ্যালয় কে দান করেন স্কুল বাড়ি নির্মাণের জন্য বাকি অংশ ছিল একজন বর্গক্ষত্রিয়ের। গ্রামের বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিগণ ওই ব্যক্তিকে অন্যত্র বসবাসের ব্যবস্থা করার পর পূর্ব দিকের অংশ বিদ্যালয়ের নামে রেকর্ড করানো হয়। এই অংশে যারা বাস করতেন তাদের মধ্যে সিধু মালিক ও হাবু মালিকের নাম জানা যায়। আরও একটি পরিবার বসবাস করলেও তাদের পরিচয় জানা যায়নি। যাইহোক বিভিন্ন প্রচেষ্টার ফল স্বরূপ সম্ভাব্য ১৯৪১-১৯৪২ সালে মিডিল ইংলিশ স্কুল রূপান্তরিত হয় এক্সটেন্ডেড ইংলিশ স্কুলে অর্থাৎ পঞ্চম হইতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পঠন-পাঠনের অনুমোদন মেলে। ইতিমধ্যে অনেক বিদ্যানুরাগী এর সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে বিপিনবিহারী পান, বিমলাচরন সরকার, সত্যকিঙ্কর মাজি, গোপাল চন্দ্র দাস, হরেকৃষ্ণ হাজরা, পশ্চিমপাড়ার কাজী গোলাম এহিয়া (যিনি স্থানীয়ভাবে মিঞা সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন) , পাশের গ্রাম ভগবতীপুর-এর সিদ্ধেশ্বর সামন্ত, ধারানের আশুতোষ দে বিদ্যালয়টির ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ দেখান।

 

  বিদ্যালয়ের উত্তরণের পথটি একেবারেই যে কুসুমাকীর্ণ ছিল তা কিন্তু বলা যায় না। এই বিদ্যালয়ের জীবনেও নেমে আসে সংকটময় এক পরিস্থিতি। পাশের গ্রামের বিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা কম থাকায় অন্যান্য গ্রাম থেকে ছাত্র পাবার মানসে তৎকালীন বিদ্যালয় পরিচালন কমিটি এক্সটেন্ডেড মিডিল ইংলিশ স্কুলের স্বীকৃতির প্রশ্নে ডি.আই.(বর্ধমান) সাহেবের কাছে বারবার দরবার করেন, ফলে ডি.আই. এই বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন এবং উপযুক্ত পরিকাঠামো দেখতে না পেয়ে তিনি এটির রিকগনিশন বাতিল কেন করা হবে না তার কারণ দর্শাতে বলেন। এই চিঠি পাওয়ার পর তৎকালীন সম্পাদক বিপিনবিহারী পান ও প্রধান শিক্ষক বদরে আলম সাহেব খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন। বিপিনবিহারী পান ছিলেন সরকারি কর্মচারী এবং শিক্ষা দরদী মানুষ আর মাঠনুরপুর গ্রামের অধিবাসী বদরে আলম সাহেব অত্যন্ত সৎ এবং শিক্ষানুরাগী মানুষ ছিলেন। এই সময়ে বিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন কাজী গোলাম এহিয়া (মিঞা সাহেব)। তিনিও ঘটনার জেরে প্রথম দিকে একটু মুষরে পড়েন। তখন বাংলায় লিগ মিনিস্ট্রি চলছিল। স্থানীয় মানুষ যারা বিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন তারা সকলেই মিঞা সাহেবকে জোর দিয়ে ধরলেন, যাতে এর একটা বিহিত করা যায়। সাত্তার সাহেব নামক এক ব্যক্তির সাথে মিঞা সাহেবের আত্মীয়তা এবং ঘনিষ্ঠতা ছিল, এই সাত্তার সাহেব আবার মন্ত্রিসভার সাথে যুক্ত মানুষ ছিলেন। মিঞা সাহেব সমস্ত ঘটনা, এলাকার অবস্থা এবং স্থানীয়ভাবে বিদ্যালয়টির চাহিদা বিস্তারিতভাবে সাত্তার সাহেবকে জানিয়ে ছিলেন, ফলে সাত্তার সাহেব সরোজমিনে বিদ্যালয় দেখতে আসার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। যথা সময়ে সব ব্যবস্থা হয়, উনিও নিজে এসে সব দেখেন এবং মিঞা সাহেবের আতিথ্য গ্রহণ করে ফিরে যান। পরে খবর আসে পলাশন এক্সটেন্ডেড মিডিল ইংলিশ স্কুল যেমন চলছিল তেমনি চলবে। মিঞা সাহেবের প্রচেষ্টায় বিদ্যালয় সংকটময় পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসে। ইতিমধ্যে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে এবং সাড়ম্বরে এই বিদ্যালয়ে স্বাধীনতা উৎসব পালিত হয়। বিদ্যালয়ের পরিচালকমন্ডলী অভিভাবক মন্ডলী, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি এবং অবশ্যই ছাত্রদের সকলকে নিয়ে মহাসমারোহে স্বাধীন ভারতে ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়। ১৯৪৯ সালে 'পলাশন এক্সটেন্ডেড মিডিল ইংলিশ স্কুল' নামটি পাল্টে হয় 'পলাশন জুনিয়র হাই স্কুল'। বিদ্যালয় গৃহ বলতে ছিল বাদশাহী রাস্তার পশ্চিম ও পূর্ব দিকে উত্তর ও দক্ষিণের লম্বা মাটির দেওয়াল দেওয়া দুটি ঘর, যার খুঁটি বাঁশের আর ছাউনি ছিল খড়ের। প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং জুনিয়র হাইস্কুল একসাথে থাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সপ্তম অষ্টম শ্রেণীর ক্লাস নিতেন পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় পৃথক হয়ে যায়। তৎকালীন সময়ে শিক্ষকদের বেতন খুবই কম ছিল, সরকারি সাহায্য ছিল খুব কম। ছাত্রদের জন্য ধার্য করে দেওয়া মাসিক তিন টাকা বেতন থেকে বিদ্যালয় চালাবার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনার পর মাস্টারমশাইদের দেবার মত অর্থ খুব কমই থাকতো। তৎকালীন দিনে একজন পাস গ্র্যাজুয়েট শিক্ষকের বেতন ছিল ১৬৪ টাকা, অনার্স গ্যাজুয়েট শিক্ষকের বেতন ছিল ২২০ টাকা আর পোস্ট গ্রাজুয়েট শিক্ষকের বেতন ছিল ২৪০ টাকা। কিন্তু এই সংখ্যাগুলি ছিল খাতায়-কলমে, বাস্তবে দেখা যেত শিক্ষকরা ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মত বেতন হাতে পেতেন। আর বাড়ি ঘর মেরামতের জন্য কোন অনুদান পাওয়া যেত না। তবে মিঞা সাহেব ও বিপিনবাবু মাস্টার মশাইদের সামান্য প্রাপ্যটুকু মিটিয়ে দিতে সদা সচেষ্ট ছিলেন।

 

  মিঞাসাহেব অনেক বছর ধরে বিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন। নিজে বেশি লেখাপড়া জানতেন না, কিন্তু তখন তার শিক্ষার প্রতি যে দরদ তা অনেক উচ্চশিক্ষিতের মধ্যেও দেখা যেত না। তখনকার দিনে পলাশনে একটি ক্লাব কে ঘিরে বিরাট সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে ওঠে। যে ক্লাব তারা গঠন করেছিলেন তারই ফলস্বরূপ আজকের পলাশনের বিবেকানন্দ ক্লাব ও পাঠাগার। গ্রামের তরুণ সম্প্রদায় অত্যন্ত থিয়েটার প্রেমী ছিলেন। এদের অনেকেই আবার বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। থিয়েটারকে ঘিরে যে উদ্যোগ ছিল তার বহু উদ্যোক্তাদের মধ্যে পঞ্চানন ঘোষ, অভয়পদ রায়, সত্যকিঙ্কর ঘোষ, প্রভাষ তা, শশাঙ্ক শেখর যশ, বাদল রায়, রামকৃষ্ণ কর্মকার মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন। এই ক্লাবের সদস্যরা মিলিতভাবে চেষ্টা করে রাস্তার পূর্ব দিকের অংশে একটি দক্ষিণ দুয়ারী টিনের ছাউনি দেওয়া চারটি কক্ষ বিশিষ্ট বাড়ি নির্মাণ করেন।   ২০০৫ সালে নতুন বিল্ডিং হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অক্ষত ছিল এটি। এই সময়ের মধ্যে সম্পাদক এবং প্রধান শিক্ষক বদল হয়ে যান কিন্তু মিঞা সাহেবই সভাপতি থেকে যান। এই বিদ্যালয়ের অগ্রগতিতে যাদের অবদান এককথায় ছিল অনস্বীকার্য তাদের মধ্যে প্রথমেই নাম করতে হয় কাজী গোলাম এহিয়া বা মিঞা সাহেবের। তার সম্পর্কে আগেই অনেক কথা বলা হয়েছে এছাড়াও বদরে আলম, বিপিনবিহারী পান, বিমলাচরণ সরকার, সত্যকিঙ্কর মাজি, জয়ন্তি কুমার মুখোপাধ্যায়, ডঃ ভবানীশঙ্কর বসু,শ্যামাপদ সোম, জিতেন্দ্রনাথ পান , ডঃ শশধর পান প্রমুখ ব্যক্তিগণ বিদ্যালয়ের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। বাংলায় ১৩৪৯ বঙ্গাব্দে সারাদেশ জুড়ে এক ভয়াবহ ঝড় হয় আশ্বিন মাসে। এখনো বহু প্রাচীন মানুষ সেই আশ্বিনের ঝড়ের ভয়াবহতা ভুলতে পারেননি। ঝড়ের দাপটে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে, এলাকায় ব্যাপক খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেয়। রাস্তার পশ্চিম দিকে স্কুল বাড়িটির চরম ক্ষতি হয়। এই সময় ওই মিঞা সাহেবই খড়, বাঁশ, তালগাছ এবং অর্থ সাহায্য দিয়ে বিদ্যালয় কে আবার খাড়া করেন। এই সময় যারা বিদ্যালয় পড়াতেন তারা ছিলেন সত্যকিঙ্কর বারুই, গোপাল চন্দ্র দাস, নন্দলাল যশ, শশধর লাহা, মদন মোহন চক্রবর্তী, শশাঙ্ক শেখর ঘোষ, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, বিমানবিহারী মন্ডল, লক্ষীনারায়ন হাটি প্রমূখ। এনাদের সঙ্গে অল্প দিনের জন্য হলেও যুক্ত হয়েছিলেন সুনীল বরণ কোনার ও পতিতপাবন সরকার। এরা ছাড়াও পঞ্চানন হাজরা (যিনি বিদ্যালয়ের করণিক ছিলেন), বিমলাচরণ সরকার (যিনি বিদ্যালয়ের সম্পাদক ছিলেন) ও প্রমুখরা। শিক্ষকদের অনুপস্থিতিতে আবার কোন কোন সময় এনারাই নিয়মিত পড়াতেন।

  বিদ্যালয়টির কঠিন সময়ে একে টিকিয়ে রাখার জন্য বিপিনবিহারী পান, সত্যকিঙ্কর মাজি, বিমলাচরণ সরকার, মিঞা সাহেব যে ভূমিকা নিয়েছিলেন তা এককথায় এই বিদ্যালয় ক্ষেত্রে চিরস্মরণীয়। এখান থেকে যে সমস্ত ছেলে মেয়ে অষ্টম শ্রেণীর পর পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়গুলিতে ভর্তি হতো তারা কিন্তু বেশ ভাল ফলাফল করে বিদ্যালয়ের মর্যাদা অনেক বাড়িয়ে দিত।

  

  দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও প্রায় ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ে কেবলমাত্র ছেলেরাই পড়াশোনা করত তবে ১৯৫১-৫২ সাল থেকে মেয়েরা পড়তে শুরু করে। যদিও তাদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। সরকারি তরফে যাতে মেয়েরা বিদ্যালয় আসে তার জন্য মেয়েদেরকে co-educational গ্র্যান্ট দেবার মনস্থ করে সরকার। সরকার বিদ্যালয়ের পাঠরতা মেয়েদের সংখ্যা এবং কোন ক্লাসে পড়ে তার ভিত্তিতে গ্র্যান্ট দিতে শুরু করে। এর ফলে এলাকার মেয়েরা পড়াশোনার সুযোগ পায়। বহু অভিভাবক মেয়েদের শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে শুরু করে। তবে লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, মেয়েদের যোগদান বিদ্যালয়ে একেবারেই বেশি সংখ্যায় ছিলনা। তৎকালীন সময়ে সমাজের একেবারে উঁচু পরিবারের অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের বিদ্যালয় পাঠাতেন। সমাজের সব স্তরের মানুষ কিন্তু তাদের মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠায়নি। তৎকালীন মানুষের নারী শিক্ষার প্রতি অনীহা এবং আর্থিক অসচ্ছলতাকেই এর জন্য দায়ী করা যেতে পারে। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত গতানুগতিকভাবে পলাশন জুনিয়র হাই স্কুল চলতে থাকে। এই সময়ের মধ্যে শান্তি নাথ চক্রবর্তী (আউশাড়া) এবং অমরেন্দ্রনাথ পান (যিনি এখান থেকে সহকারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন) যোগ দেন। ১৯৬৪ সালের পর থেকে এক নতুন উদ্যোগ শুরু হয় তৎকালীন পঞ্চায়েত প্রধান জিতেন্দ্রনাথ পানের নেতৃত্বে এবং এক বিদ্যানুরাগী ব্যক্তি জয়ন্তি কুমার মুখোপাধ্যায় এর অর্থানুকূল্যে উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার এক ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা ডেকে পার্শ্ববর্তী সমস্ত গ্রামের বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিদের নিয়ে শুরু হয় এক কর্মযজ্ঞ। যারা নেতৃত্বে এগিয়ে এলেন তাদের মধ্যে রামবাটির কৃষ্ণদাস মুখোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায়, সুধাকর কোঙার, ধারানের সিদ্ধেশ্বর দে, ভবানীশঙ্কর হাজরা, মনোরঞ্জন ঘোষ, পঞ্চানন ঘোষ, পতিতপাবন সরকার, ভগবতীপুর এর সিদ্ধেশ্বর সামন্ত, পশ্চিমপাড়ার মিঞা সাহেব উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু মানুষের শুভেচ্ছা ও চেছেস্তায় ১৯৬৫-৬৬ শিক্ষাবর্ষে প্রথম নবম শ্রেণী খোলা হয়।

 

  উচ্চবিদ্যালয়ের পরিকাঠামো কিছুই ছিল না, প্রায় শূন্য থেকেই আরম্ভ করা হয়েছিল। ঘর নেই, পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, ছাত্রছাত্রীদের বসার বেঞ্চ নেই, এমনকি ভালো লেখার বোর্ড পর্যন্ত নেই, তবুও প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করে ১৯৬৭ সালে কিছু নির্দিষ্ট শর্তে এটি উচ্চবিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভ করে। ছিলনা অনেক কিছু কিন্তু যা ছিল তা হলো বহু মানুষের অকুণ্ঠ সহযোগিতা এবং শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিকতা। এই সময়ে যারা শিক্ষকতা করেছিলেন তাঁরা হলেন কার্তিক কিংকর মুখোপাধ্যায়, অমরেন্দ্রনাথ পান, মদনমোহন চক্রবর্তী, শান্তিনাথ চক্রবর্তী, জয়দেব ভট্টাচার্য, ভবানী প্রসাদ ভট্টাচার্য, কানাইলাল কোঙার, পতিতপাবন সরকার, অনিল কৃষ্ণ পাঁজা, মনোজ কুমার দে, সুধীন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী প্রমুখ। তিন-চার বছরের মধ্যেই এলেন গৌরি প্রসন্ন রায়, অজিত কুমার চন্দ্র, প্রাণবল্লভ বারিক, সুশীল কুমার হাজরা, শিক্ষা কর্মী হিসেবে ছিলেন দাশরথি চ্যাটার্জী, অজিত কুমার নন্দী, সত্য বালা দাসি। পরে এলেন রনজিত বসু, মধুসূদন ঘোষ।

  শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি জয়ন্তি কুমার মুখোপাধ্যায় বিদ্যালয়ের উন্নতিকল্পে ১৯৬৫ সালে আনুমানিক ১ লক্ষ টাকা বিদ্যালয় তহবিলে দান করেন। তার ইচ্ছানুসারে বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় তার মা মৃণালিনী দেবীর নামে। ১৯৬৬ সালে পলাশন জুনিয়র হাই স্কুলের নাম পরিবর্তিত হয় এবং নতুন নাম হয় 'পলাশন মৃণালিনী মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়'। অপর এক শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি শংকর মুখোপাধ্যায় বিদ্যালয়টিকে লাম্পগ্রান্ট থেকে ১৯৭২  সালে ডেফিসিট গ্র্যান্ট -এ নিয়ে যেতে বিশেষ সহায়তা করেছিলেন।  তার অবদানের কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ। উচ্চবিদ্যালয়ে রূপান্তর ঘটলেও বিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা খুব কম ছিল। ভালো ছাত্র প্রায় নেই, যাও থাকতো তাও আবার অষ্টম শ্রেণী থেকে অন্যত্র চলে যেত। শিক্ষক এবং শিক্ষা কর্মীদের বেতন ছিল খুব কম। ভালো ফল করার জন্য শিক্ষক মহাশয়রা উঠে পড়ে লাগলেন, ফলে কয়েক বছরের মধ্যে বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী স্কুল ফাইনালে খুব ভালো ফল করে। যারা আজ জীবনে খুবই সুপ্রতিষ্ঠিত। ক্রমাগত ভালো ফলাফলের পর যারা ছেলেমেয়েদের অষ্টম শ্রেণির পর অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার প্রবণতায় ভুগছিলেন তারাও এরপর নিয়ে যাওয়া বন্ধ করেন।

   উচ্চ বিদ্যালয় শুরুর প্রথম লগ্নে যিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন সেই কার্তিক কিংকর মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাম্রপত্র প্রাপ্ত একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। উনি কুকুরা সিনিয়র স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এই এলাকার কিছু মানুষ যেমন জিতেন্দ্রনাথ পান, ভবানীশঙ্কর হাজরা, অমরেন্দ্রনাথ পান, কৃষ্ণদাস মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা ওনাকে এখানে আনার ব্যবস্থা করেন। কারণ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা যোগ্যতা অনুযায়ী কোনো স্থায়ী প্রধান শিক্ষক না থাকলে ইন্সপেকশন করানো যেত না। যাইহোক, এনাদের আন্তরিক চেষ্টায় এবং বিখ্যাত রাজনীতিবিদ দাশরথি তা মহাশয়ের পরামর্শে উনি তার নিশ্চিত চাকরি ছেড়ে এই বিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে সুনামের সাথে অবসর গ্রহণ করেন।

  সরকারি আদেশবলে ১৯৭৫-৭৬ সালে বেশকিছু ওল্ড হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল টুয়েলভ ক্লাসে উত্তীর্ণ হতে না পারায় টেন ক্লাসে নেমে যায়, ফলে এই বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ছাত্র সমস্যা অনেকটা মিটে যায় এবং বহু ভালো ভালো ছাত্র-ছাত্রী থেকে যায়, ফলে পরবর্তীতে বিদ্যালয়ের রেজাল্ট খুবই ভালো হতে শুরু করে। এরপর থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বিদ্যালয় চলে স্বাভাবিক ছন্দে। স্কুলের সুখ-দুঃখের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল ভামিনী রঞ্জন সরকার নামে এক ডাক্তার বাবু, উনি বি.ডি.আর রেলপথের গুইর স্টেশন সংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। ডাক্তারি করতে কেন এখানে এসেছিলেন তা জানা যায়নি। বিদ্যালয়ের দক্ষিণের ছুতারদের বাড়ির পরেই ওনার ডাক্তার-খানা ছিল। বিদ্যালয় চলাকালীন বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সব সমস্যাই তিনি যত্নসহকারে সামলাতেন, আর পরীক্ষা চলাকালীন ক্লাসে ক্লাসে ঘুরে ছাত্র ছাত্রীদের উৎসাহ দিতেন। ব্যক্তিটি শিক্ষায় গভীর আগ্রহ পোষণ করতে। ১৯৮০ সালের একটু পরেই বিদ্যালয় পরেশনাথ পাঁজা, সুশান্ত কুমার নন্দী, স্মৃতিকণা ঘোষ, নির্মল কুমার হাজরা যোগদান করেন ও তারও কিছু পরে এলেন  দেব নারায়ন ভট্টাচার্য, বন্দনা দাস ও রঞ্জিত মোদক প্রমুখরা।

  আসে ১৯৮৪ সাল। শতবর্ষের বছর। শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী, প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী, পরিচালন সমিতির সভ্যবৃন্দ এবং এলাকার উৎসাহী শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিগনের সভায় তিন দিন ধরে শতবর্ষ পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। সকল মানুষের পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতায় বিভিন্ন মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনদিন শতবর্ষ উৎসব পালন করা হয়। অনুষ্ঠানের বিভিন্ন দিনে যারা এসেছিলেন তারা হলেন আব্দুল বারি (প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গ সরকার), মেহেবুব জাহেদী(জেলা সভাধিপতি), পঞ্চানন মন্ডল (অধ্যাপক, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়), বিনয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় (অধ্যক্ষ, আনুর বি.এড. কলেজ), বর্ধমান মহিলা কলেজের দু-তিনজন অধ্যাপিকা, স্থানীয় বিধায়ক ধীরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী (রায়না বিধানসভা) এবং সুধাকর কোঙার (প্রধান, পলাশন গ্রাম পঞ্চায়েত)। এছাড়াও স্থানীয় উচ্চবিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক-শিক্ষিকাগন অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। শ্রুতিনাটক শোনাতে এলেন অজিত গাঙ্গুলী ও শর্মিষ্ঠা গাঙ্গুলী। সংগীত, খেলাধুলা, বিতর্ক, নাটক, আলোচনা ইত্যাদি মিলিয়ে তিন দিনের জমজমাট অনুষ্ঠানের পর কিছুদিনের মধ্যে বের করা হয় বিদ্যালয় পত্রিকা। এই শতবর্ষ অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে একটি ছোটখাটো বিজ্ঞান প্রদর্শনীর আয়োজনও করা হয়েছিল। এর আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছিল উদগরা গ্রামের বাসিন্দা শেখ নাজির হোসেন। উনি বহু প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহ করে শতবর্ষ কমিটির হাতে অর্পণ করেছিলেন। এটি খুবই আনন্দদায়ক হয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে যথারীতি ফেরতও দেয়া হয়।

 

  ১৯৮৪-র পর বিদ্যালয় তার স্বাভাবিক ধারায় এগিয়ে যেতে থাকে, কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো ১৯৮৫-৮৬ সাল থেকে বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। শুধুমাত্র এই অঞ্চল নয়, অন্যান্য পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ছেলেমেয়েরাও এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে শুরু করে, ফলে পর্যাপ্ত শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষ ও পরিকাঠামো প্রভৃতির সংকট দেখা দেয়। ফলত: উক্ত বিষয় নিয়ে বিদ্যালয়ের পরিচালন কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়। সরকারের কাছে এবিষয়ে বিশেষ সাহায্যের জন্য দরবার করা হয়। আবার অন্যদিকে বিদ্যালয়টিকে উচ্চমাধ্যমিকে রূপান্তরের দাবি ওঠে। কেননা মাধ্যমিকের পরে এই বিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শ্যামসুন্দর কলেজ বা রায়না উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দ্বাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হতে হতো, যা খুবই খরচ সাপেক্ষ ছিল, ফলে মেয়েদের এবং পিছিয়ে পড়া অথচ মেধাবী ছাত্রদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হতো। সবথেকে বেশি অসুবিধা ছিল মেয়েদের ক্ষেত্রে, বিংশ শতকের নয়ের দশকে মেয়েদের গ্রামের বাইরের কোন কলেজে বা স্কুলে পড়াশোনা করতে যাবার রেওয়াজ প্রায় ছিল না বললেই চলে। তাই উচ্চমাধ্যমিকে রূপান্তরের দাবির পাশাপাশি মেয়েদের জন্য পৃথক বালিকা বিদ্যালয় গড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এ ব্যাপারে গ্রামেরই কিছু শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি পরিচালন কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরই ফলস্বরূপ ২০০০ সালে পলাশন মৃণালিনী মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় উচ্চমাধ্যমিকে রূপান্তর হয়। এ ব্যাপারে উদ্যোগ ছিল মূলত তৎকালীন প্রধান শিক্ষক দীনবন্ধু দাস ও সম্পাদক তরণী কুমার চন্দ্র মহাশয়ের। অন্যদিকে তার পরের বছরই ২০০১ সালে পলাশন গ্রামে ক্রমবর্ধমান  ছাত্র সংখ্যার কথা চিন্তা করে সরকার পৃথক বালিকা বিদ্যালয় করার অনুমতি দেয়। মাত্র তিনজন পূর্ণ সময়ের শিক্ষিকা নিয়ে এই বিদ্যালয়েই প্রাত: বিভাগে শুরু হয় বালিকা বিদ্যালয়।

 

  এই সময়ে প্রধান শিক্ষক দীনবন্ধু দাস মহাশয় অবসর গ্রহণ করলে টিআইসি হিসাবে স্কুলের দায়িত্ব সামাল দেন মনোজ কুমার দে মহাশয়, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক হিসেবে ড. দীনবন্ধু ঘটক মহাশয় কে পেয়ে যায়। তিনি আসার পর থেকেই বিভিন্ন সরকারি স্কিম এর সহায়তায় স্কুলের উন্নতি ধীরে ধীরে আরো পরিলক্ষিত হতে থাকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কাঁচা ভবনগুলি অদৃশ্য হয়ে পাকায় রূপান্তরিত হতে থাকে এবং এর পাশাপাশি এস.এস.সি পরীক্ষা শুরু হয় ও  বিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষকরা আস্তে আস্তে অবসর গ্রহণ করলে বিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষক শিক্ষিকার সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিদ্যালয়ে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাব থাকলেও যোগ্যতাসম্পন্ন কিছু শিক্ষক সেই সমস্যা সমাধান করে বিদ্যালয় কে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে সাহায্য করেন। অবশেষে এই বিদ্যালয় ২০০৯ সালে ১২৫ বছরে পদার্পণ করল। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ও সম্পাদক চন্দ্রের উদ্যোগে শতোত্তর রজত জয়ন্তী বর্ষ পালনের সিদ্ধান্ত হয়। গঠিত হয় শতোত্তর রজত জয়ন্তী বর্ষ উদযাপন কমিটি। এই কমিটির উদ্যোগে ২০১০ সালের ১৭ ও ১৮ই ফেব্রুয়ারি মৃণালিনী মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ে ১২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান মহাসমারোহে পালন করা হয়। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন তৎকালীন উচ্চ শিক্ষা মন্ত্রী মাননীয় সুদর্শন রায়চৌধুরী মহাশয়, এছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন বর্ধমান জেলা  সভাধিপতি উদয় সরকার মহাশয় এবং স্বপন সামন্ত (বিধায়ক, রায়না বিধানসভা)  ও শ্যামাপ্রসাদ পাল(প্রাক্তন বিধায়ক) আব্দুল হাই (জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক) প্রমুখরা। এছাড়া অনুষ্ঠানে বিশেষ বক্তৃতা দেন অধ্যাপক অরূপ মুখোপাধ্যায় ( তৎকালীন ডিন, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়)। অতঃপর অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে সর্বশিক্ষা মিশনের উদ্যোগে বিদ্যালয় কম্পিউটার শিক্ষা চালু হয় ২০১২ সালে (যদিও এর আগেও সম্ভবত ২০০৪-০৫ সালের দিকের শুরুতে একটি কম্পিউটার নিয়ে বিদ্যালয়ে কম্পিউটার শেখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়)। বর্তমানে ডিজিটাল ক্লাস রুমেরও ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি বিষয়ের জন্য মোটামুটি ভাবে রয়েছে আলাদা আলাদা ল্যাব ও পর্যাপ্ত ল্যাব ইন্সট্রুমেন্ট, চার হাজারের বেশি সংখ্যক বই নিয়ে রয়েছে লাইব্রেরীর ব্যবস্থা, যদিও আলাদা করে কোন লাইব্রেরী রুম বা লাইব্রেরিয়ান নেই তাও বিদ্যালয়ের শিক্ষক জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ন লাহিড়ী মহাশয়ের তত্ত্বাবধানে সেটিও ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এই সময়কালে প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের হাত ধরে ও সহ শিক্ষকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিদ্যালয় অনেক উন্নতি সাধন করেছে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো ফলাফল ফলাফল ব্যাপকহারে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রধান শিক্ষক ডঃ দীনবন্ধু ঘটক মহাশয়ের অবসর গ্রহণের পর  টি.আই.সি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন দেবনারায়ণ ভট্টাচার্য মহাশয়। অল্প কয়েক দিনের জন্য হলেও তিনি তার দক্ষতার ছাপ রেখে যান ও ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ২০১৯ সালের মধ্যবর্তী সময় কাল থেকে টি.আই.সি হিসেবে স্কুলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন জগত কুমার দাস মহাশয়। পলাশন মৃণালিনী মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের মতো প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানটি বহু চড়াই-উতরাই এর মধ্য দিয়ে আজ একশত ছত্রিশ বছর পার হয়ে এক দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে উন্নতির শিখরের অভিমুখে।

© PMMHS.

Proudly created with Wix.com

bottom of page